শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ || ৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ধারাবাহিক উপন্যাস

বলতে এলাম ভালোবাসি : পর্ব-৩

পলাশ মাহবুব

১৯:২৪, ১৭ নভেম্বর ২০২০

আপডেট: ১২:৩৪, ১৯ নভেম্বর ২০২০

১৭৯২

ধারাবাহিক উপন্যাস

বলতে এলাম ভালোবাসি : পর্ব-৩

বলতে এলাম ভালোবাসি

ধারাবাহিক উপন্যাস

পলাশ মাহবুব

পর্ব-৩

৫.
জসিমউদ্দিন বাংলা কলেজে কোনও নির্বাচিত ছাত্র সংসদ নেই।
বেশ কয়েক বছর ধরে নির্বাচন বন্ধ আছে। 
কয়েকবার নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয়নি। উল্টো দু’পক্ষের মারামারিতে রক্তারক্তির ঘটনা ঘটেছে। গুলিতে এক ছাত্রের শরীর এফোঁড়-ওফোঁড় হয়েছে। কলেজের গাড়ি পুড়েছে বেশ কয়েকটি।
এখন সে উদ্যোগে ভাটা পড়েছে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারাই কলেজের মাতবর। তারাই সবকিছু নিয়ন্ত্রন করে। 
বিরোধী পক্ষরা চুপচাপ। তারা অতিথি পাখির মতো শীতের অপেক্ষায় আছে। শীতের আঁচ পেলে ডানা ঝাপটানো শুরু করবে।
আর যারা সাম্রাজ্যবাদীদের আস্তানা বহুদিন ধরে জ্বালিয়ে দাও গুড়িয়ে দাও বলে শ্লোগান তুলছে তারাও আছে তাদের মতো। শীত বা গরম তাদের জন্য ব্যাপার না। শীত-গ্রীষ্মে তাদের একই পোশাক। সুতরাং তাদেও শ্লোগান চলছে।
ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের মূল নেতার নাম বাবুল। বলা হয়ে থাকে তার বয়স কলেজের অনেক শিক্ষকের চেয়ে বেশি। অনেক শিক্ষককে সে তুমি করে বলে। ক্ষেপে গেলে কাউকে কাউকে তুই করে বলার নজিরও আছে। 
একবার এক শিক্ষকের কলার চেপে ধরে হাত ওপরে তুলেছিলো। শেষ মুহুর্তে শিক্ষক কিছু একটা বলায় হাতটা জায়গা মতো ফিরে এসেছিলো। নতুবা অন্যকিছু ঘটে যেতে পারতো।
হাত তোলার পর শিক্ষক বাবুলকে কি বলেছিলেন সেটা নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে।
কেউ কেউ, যারা বাবুলের অনুসারি তারা বলে, শিক্ষক হাতজোড় করে বলেছিলেন, এবারের মতো মাফ করে দেন বস। গায়ে হাত তুললে সম্মান নিয়ে আর চাকরি করতে পারব না। আমার গায়ে হাত তোলা আর পেটে লাত্থি মারা সমান। দোহাই লাগে পেটে লাথি মারবেন না। পরিবার নিয়ে পথে বসতে হবে।
আবার এমনও শোনা যায়, সেই শিক্ষক বলেছিলেন তিনিও একসময় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র রাজনীতি করতেন। সরকারের ওপর মহলে তারও যোগাযোগ কম না। অস্ত্র ছাড়লেও ট্রেনিং তো ভুলে যাননি। একবার হাত তুলে দেখোই না কি করি। মাস্তানি সবার সাথে চলবে না।
বাবুল কেন শেষ পর্যন্ত শিক্ষকের গায়ে হাত তোলেনি সেটা নিয়ে নানা ধরনের কথা প্রচলিত থাকলেও তা ভেতরে ভেতরে। কিন্তু শিক্ষকের কলার যে ধরা হয়েছে মুহুর্তের মধ্যে তা ক্যাম্পাসে প্রচার হয়ে যায়। কলেজে বাবুল পায় তারকাখ্যাতি। এর আগে কোনও ছাত্রনেতা শিক্ষকের কলার চেপে ধরেনি। বাবুলই এ ধরণের কাজ প্রথম করেছে।
শিক্ষকের কলার ধরার ঘটনার প্রতিবাদে তরুণ শিক্ষকদের একটি অংশ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তারা ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ মিছিলের উদ্যোগ নেয়। 
বাবুলের লোকজন সে মিছিল শুধু লন্ডভন্ডই করেনি। কলার ধরার প্রতিবাদে যারা মিছিলে অংশ নিয়েছিলো তাদের একজনের শার্টই খুলে নিয়েছিলো। পরিকল্পনা ছিলো দিগম্বর করার। প্যান্ট খুলে ক্যাম্পাসে ছেড়ে দেয়া হবে। শেষ মুহুর্তে ওপর মহলের হস্তক্ষেপে তা আর হয়নি।
প্রথমে কলার ধরা তারপর জামা খুলে নেয়ার ঘটনা বাবুলকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। এরপর থেকে বাবুলকে আর কেউ ঘাটায় না। বিরোধীরা তো না-ই। নিজ দলের লোকজনও না। 
সেই থেকে বাবুল নির্বাচন ছাড়াই ভিপি এবং দলের কোনও কমিটি না থাকার পরেও সভাপতি। মোট কথা সে জসিমউদ্দিন বাংলা কলেজের সর্বেসর্বা। বলতে গেলে যার নামে কলেজ সেই জসিম উদ্দিনের পরেই তার অবস্থান।
বাবুল কলেজের কোন বিভাগে পড়ে তা এখন আর কেউ জানে না। তবে ভর্তির বছরটা মনে করতে পারে কেউ কেউ। 
হাতেগোনা যে দু-চারজন মনে করতে পারে তাদের মধ্যে কলেজের সবচেয়ে পুরাতন চায়ের দোকানদার ওহাব অন্যতম। যে বাবুল এবং বাবুলের লোকজনের কাছে চায়ের বিল বাবদ কয়েক হাজার টাকা পায়। পাওনা টাকার কথা সে কখনো মুখ ফুটে বলে না। সে জানে তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতি হবে বেশি। কখনো বিরোধী দল ক্ষমতায় এলে কিছূ টাকা হয়তো বাবুল আর তার লোকজনের কাছ থেকে তুলতে পারবে। যদি ততদিন পর্যন্ত বাবুল টিকে থাকে। অতীতে যেমন এখনকার বিরোধীদের কাছ থেকে কিছু পাওনা তুলেছে সে। এটাই এখানকার ব্যবসার ধরণ। যাদের হাতে ক্ষমতা তাদের কাছ থেকে টাকা চাওয়ার নিয়ম নেই। তারা যদি নিজে থেকে দেয় তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু তাদের কাছে টাকা চাওয়া যাবে না। নেতারা পকেটে হাত দেবে অস্ত্র বের করার জন্য, চায়ের বিল দেয়ার জন্য না।

ওহাব আঙুলের কর গুনে হিসাব করে জানায়, তা এগারো বছরের কম না। যখন সে এই কলেজে ব্যবসা শুরু করেছিলো। সে বছরই কলেজে নতুন ছাত্র হিসেবে ভর্তি হয় বাবুল। তারপর অনেকে এসেছে আবার বেরও হয়ে গেছে। কিন্তু বাবুল আছে আগের মতো।
পুরনোদের কাছ থেকে আরও একটি তথ্য জানা যায়। একসময় ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ছিলো বাবুল।
কিন্তু তার নিজের ইতিহাসের কাছে সে ইতিহাস ঢাকা পড়ে যায় দিনে দিনে। কেউ আর তাই তার পড়ালেখার ইতিহাস ঘাটাতে যায় না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আলোকিত স্থান। সেখানে অন্ধকার ঘেটে লাভই বা কি।
তবে তার নামের একটা ইতিহাস আছে।
নিজ দলের ছেলেরা তাকে ভাই বলে ডাকে। কেউ কেউ বস। নাম পর্যন্ত তারা যায় না। নিয়মে পড়ে না।
কিন্তু আড়ালে অনেকে তাকে ‘বাটন বাবুল’ বলে ডাকে। কেউ ডাকে ‘কলার বাবু’। 
আবার পত্রিকায় যখন মাঝে-মধ্যে তার নাম ছাপা হয় তখন ছাপা হয় এভাবে- বাটন বাবুল ওরফে কলার বাবু। শুধু বাবুল লিখলে তাকে অনেকে চেনে না।
‘জসিমউদ্দিন কলেজে বাটন বাবুল ওরফে কলার বাবুলের দৌরাত্ম্য’ কিংবা ‘চাঁদার টাকা বাটোয়ারা নিয়ে বাটন বাবুলের অনুসারীদের মধ্যে মারামারি’।
এভাবে নানা সময় খবরের শিরোনাম হয় সে। অর্থাৎ কলেজের বাইরেও বাটন বাবুল ওরফে কলার বাবুল হিসেবে তার একটা পরিচিতি আছে।
কর্মগুণেই তার নামের সাথে এই বিশেষ শব্দ দুটি যুক্ত হয়েছে। ‘কলার বাবুল’ নাম হওয়ার কারণ আগেই বলা হয়েছে। এক শিক্ষকের কলার চেপে ধরার কারণে এই উপাধি।
অন্যদিকে বাটন শব্দটি এসেছে বাংলা বোতাম থেকে। অন্যের জামার বোতাম ছেঁড়ার বদভ্যাস আছে বাবুলের।
কারও সাথে কথা বলার সময় সামনে যে থাকে তার জামার সবচেয়ে ওপরের বোতামটি ঘোরাতে ঘোরতে কথা বলে বাবুল। কাজটা যে সে ইচ্ছাকৃত করে বিষয়টা সেরকম না। নিজের অজান্তেই করে। হাত চালিয়ে অভ্যাস হয়ে গেছে। স্থিরভাবে তাই কিছু করতে পারে না। 
ডান হাতের তিন আঙুল দিয়ে বোতাম ঘোরায় আর কথা বলে বাবুল। কথা বলে আর বোতাম পেঁচায়। কথা বলতে বলতে এক সময় বোতামটা ছিঁড়েই ফেলে সে। তারপর যাওয়ার সময় বোতামের মালিকের হাতে বোতামটা দিয়ে চলে যায়।
সন্ত্রাসী হলেও সচেতন। ঠিক সেসব ছিনতাইকারীদের মতো যারা সব টাকা-পয়সা নিয়ে নেয়ার পর বাসায় যাওয়ার গাড়ি ভাড়া হিসেবে পঞ্চাশ টাকা ধরিয়ে দেয়।

শুরুর দিকে বাবুল শুধু কলেজের নতুন ছেলেদের বোতাম ছিঁড়ত। এক সময় বিষয়টা আর শুধু নতুন ছেলেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। কলেজের বড়-ছোট সবাই তার শিকারে পরিণত হয়। 
এক পর্যায়ে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায়, বাবুলের সাথে কথা বলার সময় সবাই জামার বোতামের ওপর হাত রাখা শুরু করে। যাতে হাত ভেদ করে বাবুলের হাত বোতাম পর্যন্ত না পৌঁছাতে পারে। 
আর যাদের সবসময় বাবুলের আশেপাশে থাকতে হয় অর্থাৎ যারা তার সব সময়ের সঙ্গী তারা সবাই জামা পড়া বাদ দিয়ে দেয়। সবার পড়নে একটাই ড্রেস, বোতাম ছাড়া টি-শার্ট।
বাবুলের বুদ্ধিও কম না। যখন আশেপাশে কেউ থাকে না তখন বাবুল নিজের জামার বোতামই প্যাঁচাতে থাকে। হাত চালিয়ে অভ্যাস তো। স্থির থাকতে পারে না।
যে কারণে এতবড় নেতা হওয়ার পরও বাবুলের জামায় সবসময় দু-একটা বোতাম শর্ট থাকে।
এমনি একবার তার পোস্টারের ছবিতেও ওপরের বোতামের ঘরটি খালি ছিল।
 

চলবে...

আগের পর্ব

বলতে এলাম ভালোবাসি: পর্ব-২

বলতে এলাম ভালোবাসি: পর্ব-১

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank